আজকে আমাদের সাথে আছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আবু ছুমাইয়া। যিনি ৪০তম বিসিএসে একজন পররাষ্ট্র ক্যাডার। আজকের সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর নিজের অতীত কর্মজীবন, অধ্যবসায়ের গল্প তারপর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে জার্নি এবং কর্মক্ষেত্রে তাঁর আগামীর কর্ম পরিকল্পনা সব তুলে ধরেছেন।
মর্নিং ট্রিবিউন: আপনার জীবনের মূলমন্ত্র কি ছিল ?
আবু ছুমাইয়া: সততা ও পরিশ্রম- এই দুটো ব্যাপারে ফোকাস রেখে সব কাজ এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি। এটা আমার মূলমন্ত্র বলার চেয়ে পারিবারিক শিক্ষা বললেই বেশি সঠিক হবে।
মর্নিং ট্রিবিউন: গ্রামের বাড়ি , বেড়ে ওঠা কোথায়,আপনার বাবা কি চাকুরি করতেন না ব্যবসা ? তাঁর প্রভাব কতটুকু ছিল আপনার জীবনে ?
আবু ছুমাইয়া: গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলাতে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত গ্রামেই বেড়ে উঠা। দাদা বাড়ি ও নানা বাড়ি (ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা) কাছাকাছি উপজেলায় হওয়ায় বেশ আনন্দ এবং উচ্ছ্বলতার সাথেই কেটেছে সেই সময়টা। বাবা সরকারি চাকুরিজীবী, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা। আমার জীবনে তাঁর প্রভাব বলে শেষ করার মত নয়। কর্মজীবনে তাঁর সততা, পারিবারিক জীবনে একজন আদর্শ পিতা হওয়ার গুণাবলি এবং সর্বোপরি জীবনের কঠিন সময়ে হার না মেনে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার তাঁর যে দৃঢ়তা- এসব কিছু আমাকে প্রতিনিয়ত বেশ অনুপ্রাণিত করে।
মর্নিং ট্রিবিউন: আপনার পরিবারের কে কে আছে ?
আবু ছুমাইয়া: বাবা, মা, ছোট দুই বোন। বোন দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
মর্নিং ট্রিবিউন: শিক্ষাজীবন, স্কুল,হাইস্কুল,কলেজ ভার্সিটি লাইফ নিয়ে আপনার স্মৃতিচারন ? আপনার সেশন কত ছিল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছিল কোনটি ?
আবু ছুমাইয়া: বাবার পদায়নের সুবাদে স্কুল, কলেজ জীবন কেটেছে কুমিল্লা, ফেনী এবং চাঁদপুরে। হাই স্কুল এবং কলেজ চাঁদপুরেই কেটেছে। হাই স্কুল ছিলো হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (এসএসসি ২০১১) এবং কলেজ ছিলো আল-আমিন একাডেমি (এইচএসসি ২০১৩)। তখনকার স্মৃতিচারণ করতে গেলে তা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। শুধু বলতে চাই, জীবনের মধুরতম একটা অংশ ফেলে এসেছি সেই সময়ে। কলেজ শেষে লক্ষ্য ঠিক করতে যেয়ে বেশ কনফিউজিং পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিলো ডাক্তারি পড়তে হবে, আমার আবার বুয়েটে পড়ার ইচ্ছা। পাশাপাশি তখন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ অফার পেয়েছিলাম। তখন পর্যন্ত প্ল্যান ছিলো দেশের বাইরে গেলে যাবো আন্ডারগ্র্যাড এর পর, তার আগে নয়। তাই ওই স্কলারশিপ অফারে সায় দেয়া হয়নি। পরিবারের ইচ্ছায় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই। নির্বাচিত হই সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৫২-তম এমবিবিএস ব্যাচে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে ঐ সেশনেই পাশাপাশি বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় সিলেক্টেড হই। যদিও ভর্তি সম্পন্ন করে ক্লাস শুরু করতে হয় মেডিকেলেই। ১.৫ মাসের মত এমবিবিএস এর ক্লাস করি। কিন্তু মন থেকে বুয়েটের আকর্ষণ কিছুতেই কমছিলো না। তখনও ভর্তির সময় কিছুদিন বাকি থাকাতে, অনেক চেষ্টার পর বাবা মা-কে কনভিন্স করে একবারে শেষ মুহূর্তে চলে আসি বুয়েটে। ভর্তি হই নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগে (২০১৩-১৪ সেশন)। বুয়েটের সময়টা এক কথায় ছিলো স্বপ্নের মতো। একদম মনের মতো পরিবেশ, অত্যন্ত ভালো মনের কিছু বন্ধু এবং পরিবারের মত কয়েকজন রুমমেট – এই নিয়ে খুবই ভালো কেটেছে সেই সময়। আমি থাকতাম বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলে।সৌভাগ্যক্রমে আমার রুমমেটদের মধ্যে একজন ৪০-তম বিসিএস পররাষ্ট্র সার্ভিসে আমার ভবিষ্যৎ সহকর্মী। বুয়েটের পালা শেষ করে ৪০-তম বিসিএস চলমান থাকা অবস্থায় আমি আইবিএ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এমবিএ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেছি।
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন অভিজ্ঞতা যা আপনার জীবনকে পিছন থেকে সামনে নিয়ে আসে ?
আবু ছুমাইয়া: এমন কোনো কিছু এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। আর দশটা মানুষের মতই বেশ স্বাভাবিক গতিতেই চলেছে আমার জীবনের সবগুলো ধাপ।
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন প্রতিকূলতার মুখামুখি হয়েছিলেন যা আপনার জীবনে শিক্ষনীয় হয়ে ছিল ?
আবু ছুমাইয়া: সময়ের বাস্তবতা এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম প্রত্যেককেই ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তোলার প্রয়োজনে শিক্ষা দেয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই ছিলো। আপাতত এতোটুকুই বলতে চাই।
মর্নিং ট্রিবিউন: অনেকই তো বিসিএস প্রস্তুতির জন্য সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যায় আপনি কী গিয়েছিলেন?
আবু ছুমাইয়া: আমার লাইব্রেরিতে যাওয়া হয়ে উঠেনি৷
মর্নিং ট্রিবিউন: বন্ধুদের সাথে আড্ডা হতো , বিসিএস প্রস্তুতির সময় কোন গ্রুপ ছিল স্টাডির জন্য ?
আবু ছুমাইয়া: বন্ধুদের সাথে আড্ডা প্রতিদিনের ব্যাপার ছিলো। বুয়েট লাইফের প্রেশার রিলিফের একটা উপায় বলতে পারেন। বিসিএস দেয়ার সিদ্ধান্ত তখনও নেয়া হয়নি, তাই বিসিএস কেন্দ্রিক কোনো স্টাডি গ্রুপ ছিলোনা।
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন সময় থেকে বিসিএস পড়া শুরু করলেন ?
আবু ছুমাইয়া: বুয়েট থেকে আমাদের ব্যাচ পাস করে বের হয় ২০১৮ এর অক্টোবরে। তখন ৪০ তম বিসিএস এর সার্কুলার চলমান। বন্ধুদের সাথে সেই সার্কুলারে আবেদন করি। কিন্তু পড়াশোনা সাথে সাথেই শুরু হয়নি। USA এর National Science Foundation এর একটা প্রজেক্টে কাজ করছিলাম, ঢাকা কেন্দ্রিক Research Assistant হিসেবে। কাজের ভিত্তিতে দুটো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি স্কলারশিপ এর অফারও পাই তখন। চলে যাবো, নাকি দেশেই থাকবো- এটা নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় ছিলাম। শেষে বিসিএস দেয়ার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়। ঐ সেশনেই এমবিএ করার জন্য ভর্তি হই আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমবিএ-এর রেগুলার ক্লাস আর বিসিএস প্রস্তুতি পাশাপাশিই চলতে থাকে।
মর্নিং ট্রিবিউন: বিসিএসের প্রিলি, রিটেন,ভাইভা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আর নতুনদের জন্য গাইডলাইন ?
আবু ছুমাইয়া: সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো যে প্রিলি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ধাপ। এমনিতেই যেহেতু অনেক বড় সিলেবাস, তাই অপ্রয়োজনীয় টপিক বাদ দিয়ে, সিলেবাস ধরে পড়াশোনা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রিলি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে কত বেশি পড়লাম, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কত বার সিলেবাসটা রিভিশন দেয়া হলো। লিখিত পরীক্ষা অনেকাংশেই ক্যাডার নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাজারের প্রচলিত গাইড বই অনুসরণ না করে যত বেশি সম্ভব সোর্স থেকে পড়াশোনা করা ভালো৷ ইংরেজি, গণিত এবং বিজ্ঞানে কৌশলী হলে ভালো নাম্বার পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। খাতায় উপস্থাপনার ভঙ্গি , পরীক্ষার হলে টাইম ম্যানেজমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত। ভাইভা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিজেকে এবং “নিজ” সম্পর্কিত সব কিছু জানা (যেমন- নিজ জেলা, উপজেলা, গ্রাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) আবশ্যক। পাশাপাশি ক্যাডার পছন্দক্রমের শুরুর দিকে কয়েকটি ক্যাডারের ব্যাপারে মৌলিক জ্ঞান থাকা উচিত। সিভিল সার্ভিস হতে এক ধাপ দূরের এই পর্যায়ে নার্ভাসনেস বেশি কাজ করে। নিজের সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে সক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ এখানে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল এনে দিতে পারে।
মর্নিং ট্রিবিউন: আপনার জীবনে আপনার মায়ের প্রভাব কতটুকু ?
আবু ছুমাইয়া: সবচেয়ে বেশি। আমার মা একজন গৃহিণী। একদম শুরু থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের তিন ভাই বোনের মাথার উপর ছায়ার মতই আছেন তিনি। আমার ক্ষুদ্র জীবনে অর্জন বলে যদি কিছু থেকে থাকে, সব কিছুর পিছনেই আমার মায়ের পরিশ্রম, আশীর্বাদ এবং তাঁর অদ্ভুত সারল্য ভরা এক বিশ্বাস – এসব ছাড়া আর কিছুই দেখিনা।
মর্নিং ট্রিবিউন: কর্মক্ষেত্রে ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
আবু ছুমাইয়া: প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং একজন দক্ষ কূটনৈতিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা, যাতে দেশের স্বার্থ রক্ষায় আমার সম্পূর্ণটাই দিতে পারি৷
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন কিছু কর্মকান্ড যা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল বলে আপনি মনে করেন ?
আবু ছুমাইয়া: স্বাভাবিকের বাইরে ছন্দপতন ঘটানোর মত কিছু মনে পড়ছেনা।
মর্নিং ট্রিবিউন: বিসিএস যাদের একমাত্র গোল তাদের উদ্দেশ্য কি বলবেন ?
আবু ছুমাইয়া: সামাজিক মর্যাদা, দেশের মানুষের জন্য সরাসরি কাজ করার প্লাটফর্ম, কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে চাকুরী প্রার্থীদের প্রথম পছন্দে থাকে বিসিএস। প্যাশন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু বিসিএস-কে একমাত্র গোল মনে করা ক্ষেত্রবিশেষে সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি করতে পারে। জীবনে সফলতার সংজ্ঞা ব্যাপক ও বিস্তৃত। যে কোনো অবস্থানে থেকেই দেশ ও মানুষের জন্য অনেক ভালো কাজ করা যায়।