নাজিম উর রহমান।।
গত ৩০ মার্চ ৪০ তম বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয় ।৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে পিএসসি।যারা ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন বিভাগের ক্যাডার হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে তা নিয়ে একটি সিরিজ তৈরি করছে মর্নিং ট্রিবিউন । আজ হচ্ছে তার সতেরতম পর্ব।
আজকে আমাদের সাথে আছেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদ বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মানস কির্ত্তনীয়া (নয়ন)। যিনি ৪০তম বিসিএসে একজন পুলিশ ক্যাডার। আজকের সাক্ষাৎকারে তিনি তার নিজের অতীত কর্মজীবন আর অধ্যবসায়ের গল্প তারপর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে জার্নি এবং কর্মক্ষেত্রে তার আগামীর কর্ম পরিকল্পনা সব তুলে ধরেছেন।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ আপনার জীবনের মূলমন্ত্র কি ছিল ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমার শিক্ষক বাবা আমাকে নিয়ে বিকালে বাড়ির পাশে হাঁটতেন তখন তিনি আমাকে গল্পের ছলে বিভিন্ন ধরনের উপদেশমূলক গল্প শুনাতেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে বাবার মুখ থেকে শুনা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে লেখা একটি বাক্য ‘এসো জ্ঞানের সন্ধানে ফিরে যাও দেশের সেবায় ’। আমি আমার জীবনটাকে মানুষের উপকারে উৎসর্গ করতে চাই।
মর্নিং ট্রিবিউন: গ্রামের বাড়ি,বেড়ে ওঠা কোথায়,আপনার বাবা কি চাকুরি করতেন না ব্যবসা ? তাঁর প্রভাব কতটুকু ছিল আপনার জীবনে ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের রঘুনাথপুর গ্রাম। ছোটবেলা থেকে গ্রামেই বেড়ে উঠা। আমি মাধ্যমিক পাস করেছি আমার বাবার স্কুল থেকে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছি রাজধানীর একটি স্কুল থেকে । আমার বাবা একজন আদর্শ শিক্ষক যার কাছ থেকে আমার সকল আদর্শ শিখতে পেরেছি। বাবা আমাকে সবসময় তার কাছে পড়তে আসা ভাল ছাত্রদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতেন। যাতে আমার মধ্যে ভাল ছাত্রদের গুণাবলী তৈরি হবে।
মর্নিং ট্রিবিউন: আপনার পরিবারের কে কে আছেন?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমার পরিবারে আমার বাবা, মা, আমার স্ত্রী এবং আমার আমার বড় বোন আছেন।
মর্নিং ট্রিবিউন: শিক্ষাজীবন, স্কুল,হাইস্কুল,কলেজ ভার্সিটি লাইফ নিয়ে আপনার কোন স্মৃতিচারন বেশি মনে পড়ে? আপনার সেশন কত ছিল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছিল কোনটি ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে আমার প্রাইমারি স্কুলের কথা তখন আমরা প্রত্যেকদিন স্কুলের শেষে সব বন্ধুরা মিলে গান গাইতাম অথবা নাটক করতাম। এসব দিনের কথা আমার অনেক মনে পড়ে। আমি আমার মাধ্যমিক সম্পন্ন করি রঘুনাথপুর দীননাথ উচ্চবিদ্যালয় থেকে। উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করি কলেজ অফ ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ থেকে। তারপর ভর্তি হই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার সেশন ছিল ১১-১২ সেশন। আমার হল ছিল সিরাজউদ্দৌলা হল।
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন অভিজ্ঞতা যা আপনার জীবনকে পিছন থেকে সামনে নিয়ে আসে ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম সারির ছাত্র ছিলাম তাই সবার একটা আশা ছিল আমি মেডিকেলে পড়ব। আমার ও ইচ্ছা ছিল দেশের বাহিরে মেডিকেলে পড়ব। আমি রাশিয়ার একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি ও পাই। কিন্তু রাশিয়ান ভাষায় পড়াশোনা করতে হবে এই ভাষা ভিন্নতার কারণে বাবা মা আমার সাথে সায় দেন নি তার উপরে আমি পরিবারের একমাত্র ছেলে। তারপর আমি তারপর ভর্তি হই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে মেডিকেলে। এসব কারণে আমি এই বিষয়টার সাথে খাপ খাইয়ে উঠতে পারি নি। তাই আমি একটু পিছিয়ে পড়ি সবার থেকে। সবাই আমাকে ভিন্ন নজরে দেখত এটা আমি টের পাই। ৩৮ তম বিসিএসের প্রিলি পরীক্ষায় আমার এক পরিচিত ভাইয়ের অদ্ভুত একটা ব্যবহার ছিল আমার টার্নিং পয়েন্ট তখনই আমি প্রতিজ্ঞা করি যে আমি তার চেয়ে ভাল ক্যাডার হব এবং আমি পেরেছি। আমি ভেবেছি এবং ঈশ্বর এর আশীর্বাদে আমি আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পোঁছাতে পেরেছি।
মর্নিং ট্রিবিউন: অনেকই তো বিসিএস প্রস্তুতির জন্য সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যায় আপনি কী গিয়েছিলেন?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমি যে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যাব এটা অনেকের জন্য ভাবতে কষ্ট হত। আমি এক বড় ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ যিনি আমাকে ন্যাশনাল আর্কাইভ এর একটা কার্ড করে দিয়েছিলেন। তার মাঝে আমি আমার এক স্যারের সাথে রিসার্চের কাজে যুক্ত ছিলাম তখন আমি ল্যাবে পড়াশোনা করতাম । এই সুযোগটা করে দেওয়ার জন্য আমি আমার স্যারের কাছেও কৃতজ্ঞ।
মর্নিং ট্রিবিউন: বন্ধুদের সাথে আড্ডা হতো , বিসিএস প্রস্তুতির সময় কোন গ্রুপ ছিল স্টাডির জন্য ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমি অনেক আড্ডা প্রিয় মানুষ বন্ধুদের সাথে আমার প্রচুর আড্ডা হত। আমার অনেক বন্ধুদের মধ্যে আমাকে সবচেয়ে বেশি হেল্প করেছে সমর বিশ্বাস, মুহিদুল ইসলাম, জসিম, হোসেন। যাদের কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। আমার গ্রুপ স্টাডির কোন অভিজ্ঞতা ছিল না।
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন সময় থেকে বিসিএস পড়া শুরু করলেন ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ ৩৮ তম বিসিএসের পরে আমি পুরোদমে বিসিএসের পড়া শুরু করি।
মর্নিং ট্রিবিউন: বিসিএসের প্রিলি, রিটেন,ভাইভা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আর নতুনদের জন্য গাইডলাইন ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমি প্রিলিমিনারির জন্য একটা সিরিজের বই পড়ার জন্য। একই বিষয়ের বেশি বই পড়লে কনফিউশন তৈরি হবে। আর বেশি বেশি মডেল টেস্ট দিতে হবে। তাতে যে উপকার তা হবে তা হল নিজেকে যাচাই করতে পারবে। আমার বিশ্বাস ছিল আমি রিটেনে ভাল করতে পারব। হুবহু বই থেকে মুখস্থ করাটা ভাল ফলাফল বয়ে আনবে না কারণ একই লেখা আরও অনেক ছেলে পেলে লেখবে। নিজস্ব কিছু থাকতে হবে। রিটেনের খাতার লেখা পরিষ্কার থাকতে হবে। যাতে স্যারদের নজরে পড়ে। সবার দুটো জোন থাকবে স্ট্রং জোন আর উইক জোন। আমার টার্গেট ছিল স্ট্রং জোনকে স্ট্রংগার করতে হবে। আর উইক জোনকে অ্যাভারেজে আনতে হবে । এই স্ট্রাটেজি প্রিলি, রিটেন দুইটার জন্যই কার্যকরী।
আর ভাইভাতে কমন টপিক গুলো যেমন মুক্তিযুদ্ধ,আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম,জেলা ইত্যাদি সম্পর্কিত প্রশ্নগুলতে ভুল করা যাবে না। সাম্প্রতিক সকল বিষয় সম্পর্কিত ভাল জ্ঞান থাকতে হবে। আপনার পছন্দের তালিকার বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাল ধারণা রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভাল ধারণা থাকতে হবে। ইংরেজিতে কথা বলার ভাল দক্ষতা থাকতে হবে।
মর্নিং ট্রিবিউন: কোন কিছু কর্মকান্ড যা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল বলে আপনি মনে করেন ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমার বাবা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। তিনি আমাকে সবসময় মানসিকভাবে শক্ত রাখতে সাহায্য করতেন। এটা আমাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। আমার সহধর্মিণী আমাকে সবসময় সব বিষয়ে সাহায্য করেছেন।
মর্নিং ট্রিবিউন: আপনার জীবনে আপনার মায়ের প্রভাব কতটুকু ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃ আমার জীবনে আমার মায়ের একটা প্রচণ্ড প্রভাব আছে। মায়ের স্কুলের ছাত্র আমি । তাহলে বুঝেন প্রভাব কতটুক। এবং ভাইভা বোর্ডের একটা প্রশ্নের উত্তর ছিল আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা একটা কবিতা থেকে। মায়ের ইচ্ছা ছিল আমি ক্যাডার হতে পারলে হয়ত বা তার সকল ইচ্ছা পূরণ হবে। ভগবান সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন।
মর্নিং ট্রিবিউন: কর্মক্ষেত্রে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃকর্মক্ষেত্রে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেওয়া ও সুনামের সহিত চাকুরীজীবনে ইতি টানা।
মর্নিং ট্রিবিউন: বিসিএস যাদের একমাত্র গোল তাদের উদ্দেশ্য কি বলবেন ?
মানস কির্ত্তনীয়া নয়নঃবাজারে প্রচলিত একটা কথা আছে বিসিএস এর জন্য পড়লে অন্য চাকরির জন্য পড়া যায় না । আমি এর সাথে একমত না। কারণ কোনটাতে নম্বর কম বেশি হতে পারে। কিন্ত পড়া সব বিষয়েরই মোটামুটি কাছাকাছি।প্রত্যেকটা দিন নিজের আত্নউন্নয়নের পিছনে ব্যয় করতে হবে।