নাজিম উর রহমান
গত ৩০ মার্চ ৪০ তম বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয় ।৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে পিএসসি।যারা ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন বিভাগের ক্যাডার হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে তা নিয়ে একটি সিরিজ তৈরি করছে মর্নিং ট্রিবিউন । আজ হচ্ছে তার ১৬তম পর্ব।
আজকে আমাদের সাথে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মোঃ হাবিবুর রহমান যিনি ৪০তম বিসিএসে কাস্টমস এন্ড এক্সাইজ ক্যাডার। আজকের সাক্ষাৎকারে তিনি তার নিজের অতীত কর্মজীবন আর অধ্যবসায়ের গল্প তারপর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে জার্নি এবং কর্মক্ষেত্রে তার আগামীর কর্ম পরিকল্পনা সব তুলে ধরেছেন।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ আপনার জীবনের মূলমন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাই ?
মোঃ হাবিবুর রহমান:আমার কাছে জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে 'পরিশ্রম কর,এগিয়ে যাও।'
মর্নিং ট্রিবিউনঃ গ্রামের বাড়ি , বেড়ে ওঠা কোথায়,আপনার বাবা কি চাকুরি করতেন না ব্যবসা ? তাঁর প্রভাব কতটুকু আপনার জীবনে ?
মোঃ হাবিবুর রহমান: ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলার অচিন্ত্যপুর নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। স্কুল, কলেজ সবই এই মফস্বলেই।এখানেই শৈশব, কৈশোর কেটেছে।বাবা পেশায় কৃষক ছিলেন। দশম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। আমার মায়ের চেষ্টা আমাকে এত দূর আসতে সাহায্য করেছে। বলা যায়, তিনি আমার বাবা, তিনিই মা। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের আমি।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ আপনার পরিবারের কে কে আছে ?
মোঃ হাবিবুর রহমান:আমার পরিবারে এখন ছোট দুই ভাই আর মা। ছোট ভাই দুটোই পড়াশোনা করছে।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ শিক্ষাজীবন, স্কুল,হাইস্কুল,কলেজ ভার্সিটি লাইফ নিয়ে আপনার স্মৃতিচারন ? আপনার সেশন কত ছিল আর কোন হলে ছিলেন?
মোঃ হাবিবুর রহমান:আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেই আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। সে সময় স্যাররা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ক্লাস ফাইভ এ ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পেয়েছিলাম।
আর হাইস্কুলও আমাদের গ্রামেই। সেখান থেকেই ২০১১ সালে এসএসসি পাস করেছি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। জিপিএ ফাইভ পেলেও বাবা তখন আর বেঁচে নেই এ সংবাদ শোনার জন্য। তারপর মিঞা জিন্নাহ আলম ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করলাম ২০১৩ সালে। কলেজের শিক্ষকগণ আমাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন, কারণ আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না।
২০১৪ সালে বাংলা বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।পরে আবার ভর্তি পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ২০১৫ সালে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ এ ভর্তি হই। তখন দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ ছিল ঢাবিতে। ভার্সিটিতে অসংখ্য বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী, সিনিয়র ভাই পরিচিত ছিল হলে থাকার সুবাদে। স্যার এ এফ রহমান হল এ সিট ছিল আমার। ভার্সিটির সবচেয়ে ছোট হল হওয়ায় অনেকে মুরগির খোঁয়াড় বলতো। এ হলেই জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন সময় কেটেছে। টিভিরুমে হইচই করে খেলা দেখা, ক্যান্টিনে একসাথে খাওয়া, হলের সামনে আড্ডা দেওয়া, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জাঁকজমক আয়োজনের কথা এখনো খুব মিস করি।সবচেয়ে মজা পেতাম পহেলা বৈশাখ ও হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিন। বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা শেষে বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরে যেতাম। এসব স্মৃতি রোমন্থন মনকে একদিকে যেমন কষ্ট দেয় অন্যদিকে আনন্দও দেয়।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ কোন অভিজ্ঞতা যা আপনার জীবনকে পিছন থেকে সামনে নিয়ে আসে?
মোঃ হাবিবুর রহমান:মানুষ মানুষে ভেদাভেদ আমাকে সবসময় নাড়া দিত। কারণ কৈশোর থেকেই আমি এ ভেদাভেদের শিকার। তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করি আমি জীবনের দৌড়ে প্রথম হবো। কোন বিশেষ ঘটনা ছিল না, অনেক ছোট ছোট অভিজ্ঞতা আমাকে এখানে এনে দিয়েছে।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ কোন প্রতিকূলতার মুখামুখি হয়েছিলেন যা আপনার জীবনে শিক্ষনীয় হয়ে ছিল ?
মোঃ হাবিবুর রহমান: এককথায় বললে দরিদ্রতা আমার সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা ছিল। তবে আমার মা ও আমার চেষ্টার কাছে এ বাঁধা হার মেনেছিল। জীবনের শিক্ষা এই যে, মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হল ইচ্ছাশক্তি।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ সবাই তো সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যায় আপনি কী গিয়েছিলেন?
মোঃ হাবিবুর রহমান: ফার্স্ট ও সেকেন্ড ইয়ার সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে নিয়মিত যেতাম। পরের বছরগুলোতে হলের রিডিংরুমে পড়াশোনা করেছি।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ বন্ধুদের সাথে আড্ডা হতো , বিসিএস প্রস্তুতির সময় কোন গ্রুপ ছিল স্টাডির জন্য ?
মোঃ হাবিবুর রহমান: সত্যি বলতে বন্ধুদের সাথে সবরকম আড্ডাই হত। এর মধ্যে পড়াশোনা নিয়েই কম হত। আমার এক রুমমেট বন্ধু ও একজনের হলের ডিপার্টমেন্টাল বন্ধুর সাথে পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতাম বেশি।বিশেষ কোন গ্রুপ স্টাডিতে বা কোচিং সেন্টার এ যাওয়া হয়নি।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ কখন থেকে বিসিএস পড়া শুরু করলেন ?
মোঃ হাবিবুর রহমান: বিসিএস এর জন্য সিরিয়াসলি পড়া শুরু করি থার্ড ইয়ার থেকে।তাছাড়া ফার্স্ট ও সেকেন্ড ইয়ার এ সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন নিয়ে বিস্তর পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম।কারণ হলের পাশেই ছিল বিখ্যাত নীলক্ষেত বুক মার্কেট। হার্ডকপি না পেলে সফটকপি পড়েছি। এই পড়াশোনার অভ্যাস আমাকে বিসিএস প্রস্তুতিতে ব্যাপক সাহায্য করেছে।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ বিসিএসের প্রিলি রিটেন ভাইভা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আর গাইডলাইন ?
মোঃ হাবিবুর রহমান: বিসিএস প্রিলিমিনারি হল বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রথম ধাপ। ২০০ মার্কের এই পরীক্ষায় কোন পাশমার্ক নেই। কত পেলে টিকবেন, সেটা একমাত্র পিএসসিই জানে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার সিলেবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশ বিষয়াবলী, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি, গাণিতিক যুক্তি, মানসিক দক্ষতা, কম্পিউটার ও তথ্য- প্রযুক্তি, সাধারণ বিজ্ঞান, ভূগোল, নৈতিকতা ও সুশাসন বিষয়গুলো থেকে প্রশ্ন আসে। এখানে ভালো করতে হলে একদিকে প্রচুর পড়তে হবে, অন্যদিকে প্রচুর মডেল টেস্ট দিতে হবে। এছাড়াও সিলেবাস অনুযায়ী ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণির বোর্ড বই এবং পাশাপাশি ভালো মানের কোন সিরিজ বই পড়তে পারেন। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাস করার পর আসে লিখিত পরীক্ষা।
দীর্ঘ সময় ধরে যারা বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন বা পরিশ্রম করছেন,তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিসিএস লিখিত পরীক্ষা। এই ৯০০ মার্কের(বোথ ক্যাডারের ৯০০+২০০) জন্য পাশ মার্ক ৪৫০(বোথ ৫৫০)।অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষায় ৫০% মার্ক পেলেই আপনি ভাইভা দেয়ার উপযুক্ত হবেন। আর ভাইভা একটু আনপ্রেডিকটাবল অর্থাৎ ভাগ্যের ছোঁয়া লাগে।
এজন্য একটি ভালো লিখিত পরীক্ষা আপনাকে অন্য সবার থেকে এগিয়ে রাখবে। বিসিএস লিখিত পরীক্ষার্থীদের আমার একান্ত কিছু পরামর্শঃ
আর বিসিএস ভাইভার জন্য
নিজ পঠিত বিষয়ের খুটিনাটি সব পড়ে যাবেন। নিজ জেলা ও উপজেলার ইতিহাস বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান, ব্র্যান্ডিং ইত্যাদি ভালো করে দেখবেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি সম্পর্কে কোন প্রশ্ন বোর্ডের সামনে ভুল করা চলবে না। পরিপাটি হয়ে ভাইভা দিতে যাবেন। উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি সুন্দর হতে হবে। ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দিবেন। না পারলে অনুমতি নিয়ে বাংলায় বলবেন। সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবেন। কোন প্রশ্নের উত্তর না জানলে দুঃখিত বলবেন। কোন ভাবেই বোর্ড মেম্বারদের সাথে তর্কে জড়াবেন না। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো, প্রধানমন্ত্রীর দশটি বিশেষ উদ্দ্যোগ, সরকারের সামনে কি কি চ্যালেঞ্জ সেসব বিষয়গুলো নোট করে পড়বেন। ভাইভার দিনকার কোন ঘটনা বা ইতিহাস ও ঐদিনকার পত্রিকার হেডিং চোখ বুলিয়ে যাবেন। আত্মবিশ্বাস রাখবেন। সফলতা আসবেই।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ আপনার জীবনে মায়ের প্রভাব কতটুকু ?
মোঃ হাবিবুর রহমান:আমার জীবনের যা সফলতা তার সবটুকুই আমার মায়ের। বলতে গেলে, তার অবদান সবচেয়ে বেশি। এটি স্বীকার করতে আমি গর্বিত।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ কর্মক্ষেত্রে ভবিষ্যত পরিকল্পনা?
মোঃ হাবিবুর রহমান:যদি এক কথায় বলি কর্মক্ষেত্রে ভবিষ্যত পরিকল্পনা হল নিজের অর্জিত মূল্যবোধ দিয়ে দেশ ও দশের সেবা করা। এছাড়া দেশের স্বাক্ষরতার হার ১০০% করতে আমি কাজ করতে চাই। আমি মনে করি, মানুষ শিক্ষিত হলে দেশ বদলে যাবে।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ কোন কিছু কর্মকান্ড যা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল বলে আপনি মনে করেন ?
মোঃ হাবিবুর রহমান:কোন বিশেষ কর্মকাণ্ড আমার জীবনের মোড় ঘুরায়নি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারাটা আমার জন্য বিশেষ ঘটনা ছিল। তারপর থেকেই আমি জীবনের আশার আলো দেখতে পাই।৪০ তম বিসিএস এ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তি সে আশাকে বাস্তব রুপ দান করেছে।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ বিসিএস যাদের একমাত্র গোল তাদের উদ্দেশ্য কি বলবেন?
মোঃ হাবিবুর রহমান:দৃঢ়ভাবে লেগে থাকলে কোনো কিছুই অজেয় নয়। বিসিএস ক্যাডার সেখানে ছোট ব্যাপার।পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না।
সম্পাদক: ড. রহমান মাসুক অফিস: ১২৯,এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫। ফোন ও ইমেইল (নিউজরুম): ০১৫৫৮১০৪১৬১; morningtribune@yahoo.com
Copyright © 2025 Morning Tribune. All rights reserved.