ইমন ইসলাম রাজু।।
১.
বাংলা ভাষার মহাকবি বললে যে নামটা প্রথমেই মাথায় আসে সম্ভবত তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। প্রতি বছর জানুয়ারিতে দেখি যশোরে বিরাট বড় করে মধুমেলা অনুষ্ঠিত হয়। যার কবিতায় দেশপ্রেম আবিষ্কার করে অসহ্য অনুতাপে পুড়ে যান সাহিত্যবিশারদগণ, জীবদ্দশায় তিনি কিছুই পাননি। কানাকড়িও না।
ধারকর্য করে, দয়াভিক্ষা নিয়ে বেঁচে ছিলেন তিনি। তবুও সবসময় খাবার জুটতো না। মাত্র ৪৯ বছরের জীবনে যত দুঃখ পাওয়া সম্ভব, সবই পেয়েছিলেন তিনি। দুঃসহ যন্ত্রনায় মৃত্যুর আগে ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য সামান্য চিকিৎসা জোটেনি তার।
অর্থাভাবে, খাদ্যাভাবে, চিকিৎসার অভাবে চরম অবহেলায় করুণতম মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিলেন তিনি। আর আজ মৃত্যুর প্রায় দেড়’শ বছর পরেও তার নামে জয়ঃধ্বনি ফুরায় না। জীবন হয়তো এমনই।
২.
বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেম ও দ্রোহের কবিদের তালিকা করলে সম্ভবত রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর নাম সবার উপরের দিকে থাকবে। ঢাবির চারুকলা থেকে শুরু করে মোংলার মিঠেখালি, রুদ্রের জয়গানে রুদ্র মেলা আয়োজিত হয় প্রতিবছর।
সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোর কিশোরী থেকে দাম্পত্য জীবনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা দম্পতি ও তার প্রেমের কবিতা পড়ে নবজাতক হাঁসের মতো কোমল হয়ে যেতে চান; আবার তারই দ্রোহের কবিতার দ্যোতনা যুবকের হৃদয়ে ফুজিয়ামার মতো লাভার শক্তি সঞ্চয় করে সমানুপাতে।
অথচ জীবদ্দশায় কী পেয়েছিলেন কবি? আক্ষরিক অর্থেই কিছুই পাননি তিনি। না যশ, না খ্যাতি, না সম্মান, না অর্থ, না প্রেম – কিছুই পাননি তিনি। শাহবাগ থেকে লালবাগ, টিএসসি থেকে পলাশী শুন্য পকেটে টইটই করে চাদিফাটা রোদ্দুরে ভবঘুরে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। একটা সিঙ্গারা খেয়ে সারা দুপুর কী অবলীলায় কাটিয়ে দিয়েছেন- তবু কেউ খেতে ডাকে নি কখনো। একের পর এক প্রেম প্রত্যাখ্যাত কবিকে ভালোবাসে নি কেউ।
মাত্র ৩৪ বছরের জীবনে কতকিছুই লিখলেন, গাইলেন; জীবদ্দশায় দুঃখ ছাড়া কী বা পেয়েছেন তেমন? জীবনের প্রতি এক প্রকার চরম হতাশায় শেষের দিনগুলোতে স্বাস্থ্যের একফোঁটা যত্নও নেননি তিনি। সঠিক চিকিৎসা ও পাননি। মারা গেলেন কবি। অভিমানে চলে গেলেন তিনি। অথচ আজ এই অবেলার প্রতি বেলায় তার নামে পুঁজো হয়। জীবন হয়তো এমনই।
৩.
মোগল ভারতের অমর কবি মির্জা গালিব যাকে দক্ষিণ এশিয়ায় উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি বলে একবাক্যে মেনে নেন বোদ্ধারা, যার শায়েরি পড়ে চোখের জলে যমুনায় ঢেউ তোলে আবালবৃদ্ধবনিতা, সেই মির্জা গালিব ও জীবদ্দশায় সম্মানটুকু পাননি।
পরাবাস্তববাদের কবি জীবনানন্দ দাশ যিনি একটা চাকরির আশায় ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে দৈন্যের দায় মাথায় নিয়ে ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেলেন (আত্মহত্যা করলেন), অসহ্য যন্ত্রণার মুক্তি দিয়ে মাত্র ৫৫ বছরের জীবনের যবনিকাপাত টেনে দিলেন, জীবদ্দশায় কী পেয়েছিলেন তিনি?
বাংলা সাহিত্যের আরেক শক্তিধর লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যার কলম ছিল তার চেয়েও শক্তিশালী। অথচ পরিবারের মুখে দুইবেলা খাবার দিতে পারেন নি তিনি। রাস্তার কলের পানি আর উচ্ছিষ্ট খেয়ে ৪৮ বছরের তিক্ত কষ্টের জীবনের থেকে তিনি পালিয়েছিলেন, জীবদ্দশায় কী পেয়েছিলেন তিনি?
৪.
হালের এমন অগণিত গুণীজনের জীবদ্দশার হতাশার কাহিনী শুনলে অজান্তেই মনের মধ্যে কোথায় যেন ডুকরে ওঠে। গুণীজন হলেই আবশ্যক না যে সবাই এখনি তোমার গুণের কদর করবে। ইতিহাস সে শিক্ষা দিচ্ছে না আমাদের। ধৈর্য রাখতে হবে, গুণের চর্চা করতে হবে, আজ নয়তো কাল রিওয়ার্ড আসবেই। আত্ম-উন্নয়ন একসময় আত্মসম্মান এনে দিবে বন্ধু।