সফলতা আসে স্যাক্রিফাইস থেকে॥৪০তম বিসিএস॥

নাজিম উর রহমান॥

গত ৩০ মার্চ ৪০ তম বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয় ।৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে পিএসসি।যারা ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন বিভাগের ক্যাডার হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে তা নিয়ে একটি সিরিজ তৈরি করছে মর্নিং ট্রিবিউন । আজ হচ্ছে তার ১৪তম পর্ব।

আজকে আমাদের সাথে আছেন , মাহমুদুল হক যিনি ৪০তম বিসিএসে সহকারী কর কমিশনার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত। আজকের সাক্ষাৎকারে তিনি তার নিজের অতীত কর্মজীবন আর অধ্যবসায়ের গল্প তারপর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে জার্নি আর তার আগামীর কর্ম পরিকল্পনা সব তুলে ধরেছেন।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ জীবনের মূলমন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাই–
মাহমুদুল হকঃ সত্যি বলতে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিলো না। জীবনের এক একটা পর্যায়ে এক এক রকম লক্ষ্য ছিল। তবে মূলমন্ত্র যদি বলেন তাহলে বলবো জীবনের মূলমন্ত্র ছিলো বর্তমানটাকে কাজে লাগানো।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ গ্রামের বাড়ি , বেড়ে ওঠা কোথায়,আপনার বাবা কি চাকুরি করতেন না ব্যবসা ? তাঁর প্রভাব কতটুকু আপনার জীবনে ?
মাহমুদুল হকঃ আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, শৈশব-কৈশোর সব ই শরিয়তপুরে। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। তবে চাকরি সূত্রে বাবা শরিয়তপুরে বাড়ি করেন তা ও আমার জন্মের প্রায় ১০ বছর আগে। আমার স্থায়ী ঠিকানা তাই শরিয়তপুর হয়ে যায়।

বাবা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, শরিয়তপুর-এর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। পরিশ্রম, সততা আর নিষ্ঠার এক অনন্য সংমিশ্রন আমার বাবা। তাই আমার জীবনের আদর্শ আমার বাবাই। বাবার চাকরিসূত্রে ডিসি অফিসে অনেকবার যাওয়া হয়েছে। সে সময়কার স্যার যারা ছিলেন তাঁরা অনেক আদর করতেন। বাবার ইচ্ছে ছিলো যাতে বিসিএস ক্যাডার হই। পড়াশুনা শেষ হতে হতে বাবার চাওয়াটাই লক্ষ্যে পরিণত হয়ে গেলো।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ আপনার পরিবারের কে কে আছে ?
মাহমুদুল হকঃ বাবা-মা, বড় তিন বোন। আমি সবার ছোট। সে অর্থে অনেক আদরে বড় হয়েছি। বাবার একার আয়ে আমরা চার ভাইবোন লেখাপড়া করেছি। মা শাসন করতেন আর বাবা আদর করতেন। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, মা অতটুকু শাসন না করলে উচ্ছন্নে চলে যেতাম। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। তাই আকাঙ্ক্ষা থাকলেও সাধ্য ছিলো না। এজন্যই হয়ত উচ্চাভিলাষী হই নি।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ শিক্ষাজীবন, স্কুল,হাইস্কুল,কলেজ ভার্সিটি লাইফ নিয়ে আপনার স্মৃতিচারন ? আপনার সেশন আর হল?
মাহমুদুল হকঃ আমার পড়াশুনার হাতেখড়ি মায়ের কাছে। স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল ধানুকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির মাধ্যমে। ২০০৪ সালের পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় শরিয়তপুর সদর তথা শরিয়তপুর জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছিলাম। ২০১০ সালে পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি আর ২০১২ সালে শরিয়তপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করি। দুটোতেই জিপিএ ৫ পেয়েছি। তারপর ২০১২-১৩ সেশনে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদে। ২০১৭ তে অনার্স শেষ করি আর ২০১৯ এ কৃষি অর্থনীতি (উৎপাদন অর্থনীতি)- তে মাস্টার্স শেষ করি। বাকৃবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে ছিলাম। স্বপ্নের বীজ বোনা শুরু হয়েছিল এখান থেকেই।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ সবাই তো সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে যায় আপনি কী গিয়েছিলেন?
মাহমুদুল হকঃ থিসিস বা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য গিয়েছি। তবে বাকৃবির সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বাইরে থেকে বই নেয়া যায় না। তাই জবের প্রিপারেশনের জন্য খুব একটা যাওয়া হতো না। হলের রুমে পড়তাম। যা বুঝতাম না তা বড় ভাইদের সাহায্য নিতাম। বন্ধুরা মিলে আলোচনা করে সমাধান করতাম।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ বন্ধুদের সাথে আড্ডা হতো , বিসিএস প্রস্তুতির সময় কোন গ্রুপ ছিল স্টাডির জন্য ?
মাহমুদুল হকঃ বিকেলে ফুটবল খেলা আর সন্ধ্যায় আড্ডা দেয়া ছিলো রোজকার ঘটনা। মাঝে মাঝে বিকেলে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে হাঁটতে যেতাম। বন্ধুরা মিলে নৌকায় ঘুরতাম। মাঝে মাঝে বন্ধুর রুমে রান্না করতাম। রাত জেগে খেলা দেখা বা দলবেঁধে ক্যাম্পাস ঘোরার অভ্যাস ছিলো।
সারাদিন যা পড়তাম তা নিয়ে ৩-৪ জন মিলে আলোচনা করতাম। একজন অন্যজনকে প্রশ্ন ধরতাম, নিজেরা মডেল টেস্ট দিতাম। ফেসবুকের ২-৩ টা গ্রুপে রাতে একবার ঢুঁ মারতাম।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ কখন থেকে বিসিএস পড়া শুরু করলেন ?
মাহমুদুল হকঃ আমার রুমমেট বিসিএস ক্যাডার ছিলেন।বিসিএসের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব বই ই আমার রুমে ছিলো। লেভেল ৪ থেকে টুকটাক প্রিপারেশন নেয়া শুরু করি। অনার্স শেষ হওয়ার আগেই গনিত, ইংরেজি, বাংলা, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিকের কিছু অংশ শেষ করেছিলাম। অনার্সের ফাইনাল এক্সামের পর পুরোপুরিভাবে মনোনিবেশ করি।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ বিসিএসের প্রিলি রিটেন ভাইভা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা আর গাইডলাইন ?
মাহমুদুল হকঃ বিসিএসের প্রিপারেশন জীবনে একবারই নিতে হয়। ওটা বেঁচেই বাকি পথ পাড়ি দিতে হয়। আমার কাছে মনে হয় প্রিলি সবসময় চ্যালেঞ্জিং, লিখিততে কৌশলী হতে হয় আর ভাইবা কনফিডেন্স আর ভাগ্যের সংমিশ্রন।
মর্নিং ট্রিবিউনঃ কোন কিছু কর্মকান্ড যা আপনার জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিল বলে আপনি মনে করেন ?
মাহমুদুল হকঃ লেভেল ২ সেমিস্টার ১ এ নিজের উপর ওভার কনফিডেন্সের কারণে পজিশন পঞ্চম থেকে ২৫ এর বাইরে চলে যায়। তখন আসলে একটা ধাক্কা খাই। ঐ ধাক্কার ফলে একাডেমিকে আগ্রহ হারাই। ধীরে ধীরে সিজিপিএ নামতে থাকে। জীবন তখন বিসিএসের দিকে মোড় নেয়।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ জীবনে মায়ের প্রভাব ?
মাহমুদুল হকঃ জীবনে মায়ের প্রভাব অনেকখানি। আমার প্রথম হাতেখড়ি মায়ের হাতে। মা ছিলেন আমার প্রথম শিক্ষক। মা সংসার সামলে আমাদের সময় দিয়েছেন। পড়াশুনার খোঁজ নিয়েছেন। আদর করেছেন আবার শাসনও করেছেন। বাড়ি ছাড়ার সময় মা বলেছিলেন মানুষের মত মানুষ হতে। চেষ্টা করেছি মায়ের কথা রাখতে। এমন কোনো কাজ করি নাই যাতে মা-বাবার সম্মান নষ্ট হয়। জীবনের সব পর্যায়ে মা পাশে ছিলেন। যখন ব্যর্থ হয়েছি তখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দিয়েছেন।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ বিসিএস যাদের একমাত্র গোল তাদের উদ্দেশ্য কি বলবেন?
মাহমুদুল হকঃ আপনার স্ট্রেনথ- উইকনেস খুঁজে বের করুন। সে অনুযায়ী পড়াশুনা করুন। সিরিয়াস হওয়ার দরকার নাই, সিনসিয়ার হলেই চলবে। নিজের উপর ভরসা রাখুন, পরিশ্রম করুন বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

মর্নিং ট্রিবিউনঃ কর্মক্ষেত্রে ভবিষ্যত পরিকল্পনা?
মাহমুদুল হকঃ দেশ ও দশের সেবা করা। নিজেকে একজন সৎ, পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু কর ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত সেহেতু সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সবাই একসাথে কাজ করবো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *