নিজস্ব প্রতিবেদক:
মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টার এবং ১২ জন মেডিকেল শিক্ষার্থীর নাম এসেছে। কোচিং সেন্টার ও শিক্ষার্থীদের নাম আসায় তদন্তে নতুন মোড় নিয়েছে। মেডিকেলের প্রফেশনাল পরীক্ষায় পাস করতে হিমশিম খাওয়া এসব শিক্ষার্থীর বিষয়ে নানা তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টার নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ডা. ইউনুসুজ্জামান খান তারিম। তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মেডিকেলে ভর্তি করেছেন। বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে তার ব্যাংক হিসাব ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। অনুসন্ধান, তিন চিকিৎসকের (শিক্ষক) জবানবন্দি ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় দায়ের হওয়া একটি মানিলন্ডারিং মামলায় চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, কোচিং সেন্টারের মালিকসহ অন্তত ৪০ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আদালেত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলেও সিআইডির তদন্ত দলের সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রমতে, খুলনা মেডিকেল কলেজের অর্থপেডিক্স বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. ইউনুসুজ্জামান খান তারিম ও তার পরিচালিত খুলনা থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেডিক্যাল
কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আলোচিত এ তারিমকে আগেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডির তদন্ত দল। তার ৩৫টি ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৫ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মেলার পর সেগুলো ফ্রিজও (স্থগিত) করা হয়। সম্প্রতি খুলনার থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টার সংশ্লিষ্ট ছয়জন চিকিৎসককে ঢাকায় সিআইডি কার্যালয়ে তলব করা হয়। এদের মধ্যে তিনজন জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
জানা গেছে, সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কাছে লিখিত জবানবন্দি দেওয়া তিন চিকিৎসক থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সাবেক শিক্ষক। এদের মধ্যে ডা. মেহেদী হাসান রানার সঙ্গে ডা. তারিমের যৌথ হাসপাতাল ব্যবসাও রয়েছে। ডা. রানা ২০১১ সাল থেকে থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখানে ক্লাস নিতে গিয়ে ডা. তারিমের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অনেক কিছুরই সাক্ষী হয়েছেন। তিনি ২০১৫-১৬ সেশনে জাতীয় মেধায় ১১তম হওয়া মুসতাসিন হাসান লামিয়ার নাম উল্লেখ করেছেন, যিনি ডা. তারিমের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পেয়ে খুলনা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন বলে সিআইডিকে জানিয়েছেন।
লামিয়ার বিষয়ে থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সাবেক আরও দুই শিক্ষক জবানবন্দি দিয়েছেন। ডা. ফিরোজ আহমেদ এবং ডা. মঞ্জুরুল ইসলাম এ ঘটনাকে খুলনার মেডিক্যাল মহলের ‘ওপেন সিক্রেট’ উল্লেখ করেছেন। তারিমের সহযোগী হিসেবে ডা. লুইস সৌরভ সরকারের নামও উঠে এসেছে। সৌরভ ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রের সমাধান করেছেন চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে।
মুসতাসিন হাসান লামিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট ভালো। ডা. তারিমের স্পেশাল ব্যাচে তিনি পড়তেন। তিনি দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় কঠোর পরিশ্রম করে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন। কে এবং কেন ষড়যন্ত্র করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার স্বামী খুলনায় কেমিস্ট্রির একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। তার স্ত্রী হিসেবে মেডিক্যালে চান্স পাওয়ায় অনেকের সহ্য হয়নি। তাই তারা মিথ্যা ছড়াচ্ছেন। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তিনি ভর্তি হননি।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্তে নাম উঠে আসা লামিয়াসহ বারও শিক্ষার্থীর নয়জনই খুলনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী। দুজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের এবং একজন গোপালগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজের। জাতীয় মেধায় ১১তম হওয়া লামিয়াসহ এসব শিক্ষার্থীর অন্তত পাঁচজনের একাডেমিক ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ মেধার স্বাক্ষর রাখলেও পেশাগত পরীক্ষায় বারবার অকৃতকার্য হয়েছেন তারা। বারবার পরীক্ষা দিয়েও কেউ কেউ এখনো ডাক্তারই হতে পারেননি।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং জেলা পুলিশ কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি সিআইডির পাঠানো ‘ইনকোয়ারি সিøপের’ তথ্য সংগ্রহে গিয়ে মুসতাসিন হাসান লামিয়া, শর্মিষ্ঠা ম-ল, নূরে মার্জিয়া এবং আসমাউল হুসনা নিহা নামের খুলনা মেডিক্যাল কলেজের চার শিক্ষার্থীর নাম-ঠিকানা সঠিক পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জবানবন্দিতে উঠে আসা যেসব শিক্ষার্থীর নাম-ঠিকানা যাচাই করছে তদন্ত দল, তাদের মধ্যে ফারিয়া ইসলাম নিলয়, নাজিয়া মেহজাবীন তিষা, আনিকা তাহসিন জেসি ও রেমি ম-লের নাম রয়েছে।
এদের মধ্যে লামিয়া এবং নিলয় শিক্ষা জীবনের চারটি পেশাগত পরীক্ষাতেই অকৃতকার্য হয়েছেন। একাধিকবার চেষ্টায় তারা থার্ড প্রফ অর্থাৎ চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় পাস করে ডাক্তার হয়েছেন। অন্যদিকে আসমাউল হুসনা নিহা এবং শর্মিষ্ঠা ম-লও প্রতিটি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন। কিন্তু তাদের অবস্থা এতই খারাপ যে, পাস করে তারা এখনো ডাক্তারই হতে পারেননি। এ ছাড়া নাজিয়া মেহজাবীন তিষাও একাধিকবারের চেষ্টায় চূড়ান্ত পরীক্ষার বাধা পার হয়েছেন বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সাবেক শিক্ষক ও চিকিৎসকের পুলিশের কাছে লিখিত জবানবন্দিতেও এসব নাম উঠে এসেছে। একজন চিকিৎসক বলেছেন, ‘তারিম ভাই লামিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে পড়াতেন। লামিয়া জাতীয় মেধায় ১১তম স্থান লাভ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্লাস পরীক্ষাগুলোতে ফেইল করতে থাকে। এ বিষয়টি খুলনায় ওপেন সিক্রেট। এ ছাড়া তারিম ভাইয়ের ব্যক্তিগত ব্যাচ থেকে অবৈধভাবে যারা চান্স পেয়েছে বলে জেনেছি এবং শুনেছি, তাদের মধ্যে খুলনা মেডিক্যালের শর্মিষ্ঠমা ম-ল, আসমাউল নিহা, নাজিয়া মেহজাবিন তিশা, ফারিহা ইসলাম নিলয়, নূরে মার্জিয়া, জেসি এবং ঢাকা মেডিক্যালে ফাইজা ও তার এক যমজ বোন রয়েছে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. ইউনুসুজ্জামান খান তারিম বলেন, তার কোচিং সেন্টারটি জনপ্রিয়। ১৭ বছর ধরে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোয় সাড়ে ১২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। একটি জনপ্রিয় কোচিং সেন্টারে এই টাকা লেনদেন হওয়া তো অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। সব ধরনের নিয়ম মেনেই এ লেনদেন হয়েছে। বিগত সময় চারটি সংস্থা তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। অস্বাভাবিক কিছু পায়নি। তিনি কোনোভাবেই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত নন। তা হলে তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কোচিং সেন্টারটি জনপ্রিয় হয়ে উঠায় অন্যরা ষড়যন্ত্র করছে। অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। সিআইডির তদন্তও তিনি নির্দেশ প্রমাণিত হবেন বলে জানান।
সিআইডির তদন্ত দলের সূত্রে জানা যায়, রেমি ম-ল ২০১৫ সালে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার আগে খুলনা মেডিক্যালের ২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী আশিক উজ্জামান সানির কাছে প্রাইভেট পড়তেন। এই সানী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং কোচিং ব্যবসায়ী এমদাদ হোসেন তাজের মাধ্যমে ওই বছর পরীক্ষার আগে হাতে লেখা ৮০টি প্রশ্ন পেয়েছিলেন। প্রশ্নগুলো তিনি রেমি ম-ল ও কাজী নিটল হায়দারকে দেন। ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্রটি পরীক্ষার হলে হুবহু মিলে গেলে রেমি ম-ল খুলনা এবং নিটল গোপালগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য বিবেচিত হন।
জানা গেছে, তাজ ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন তার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বন্ধু ডা. ফয়সাল আহমেদ সেতুর মাধ্যমে। এই সেতু ও তাজের খোঁজে মাঠে কাজ করছেন সিআইডির তদন্ত দল। অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, তাজ এখন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় উপজেলা আইসিটি অফিসার হিসেবে কর্মরত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এমদাদ হোসেন তাজ বলেন, তিনি খুলনা থাকতে ভার্সিটি কোচিং চালাতেন। সানি তার বন্ধু। তবে সানিকে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার কোনো প্রশ্নপত্র দেননি। সেতুর কাছ থেকে প্রশ্নপত্র পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সেতু তার স্কুলের বন্ধু। তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
এদিকে মেডিক্যাল প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় থ্রি ডক্টরস কোচিং সেন্টারের সম্পৃক্ততার অভিযোগ অবশ্য নতুন কিছু নয়। কোচিং সেন্টারটির প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক ডা. জেডএম সালেহীন শোভনের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তিনটি মামলা। ২০১৫ সালে চক্রটির মাস্টারমাইন্ড জসীমসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কোচিং সেন্টারটির আরেক পরিচালক মঞ্জুর আলমকেও ২০১১ সালে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। এ ছাড়া ২০১৯ সালে খুলনা থ্রি ডক্টরস কোচিংয়ে অভিযান চালিয়ে ডা. তারিমকে গ্রেপ্তার করে খুলনা জেলা প্রশাসন। এর পর র্যাবের হেফাজতেও ছিলেন তিনি।
মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মানিলন্ডারিং মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাধবী রানী পাল বলেন, মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসে মানিলন্ডারিংয়ের ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিল সিআইডি। মামলায় জসীম উদ্দিন ও আবদুস সালামসহ ১৪ জনকে আসামি করা হয়। আমরা এর বাইরেও অনেকের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি। তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ, অচিরেই আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
এদিকে, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে চিকিৎসক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতাসহ অন্তত ৪০ জনকে চিহ্নিত করেছে সিআইডি। এ চক্রেওর নেতৃত্বে ছিলেন জসীম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু ও তার পরিবারের সদস্যরা। চক্রটির ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এদের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ৯৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
জানতে চাইলে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ূন কবীর বলেন, দীর্ঘ তদন্তের পর মামলাটি চার্জশিটের উপযোগী করে গুছিয়ে আনা হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাই। তদন্তে মূলহোতাসহ চক্রটির প্রায় সব স্তরের সদস্যকেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
মেডিক্যাল প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ২০২০ সালের ২০ জুলাই মিরপুর মডেল থানায় শুরুতে পাবলিক পরীক্ষা আইনে একটি মামলা করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার-সিপিসি। এর প্রায় ৮ মাস পর ধানমন্ডি থানায় মানিলন্ডারিংয়ের আরেকটি মামলা করা হয়। জানা গেছে, প্রায় আড়াই বছরেও সিপিসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলাটির চার্জশিটের কোনো অগ্রগতি নেই।