আহমদ ছফা বইটির ‘গুরু’ ব্যক্তিটি হলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। লেখক আহমদ ছফার সরাসরি শিক্ষক কিংবা টিউটোরিয়াল ক্লাসের শিক্ষকও ছিলেন না তিনি। বরং, আহমদ ছফার পিএইচডির থিসিস সুপারভাইজার ছিলেন। টানা সাতাশ বছর রাজ্জাক সাহেবের সংস্পর্শে ছিলেন আহমদ ছফা।
থিসিসের কাজে রাজ্জাক সাহেবের বাড়ীতে প্রায়শই গেলেও থিসিস সংক্রান্ত কাজের চেয়ে ইতিহাস, রাজনীতি, সাহিত্য, ব্যক্তিত্ব আলাপই হয়েছে বেশি এবং এরই ধারাবাহিকতায় প্রফেসর রাজ্জাক সাহেব লেখক আহমদ ছফার নিকট হয়ে উঠেছেন ‘অসামান্য’ ব্যক্তি। যেমনটি লেখকের ভাষায়ঃ– ‘তাজমহলকে সামনে থেকে,পেছন থেকে,ডাইনে থেকে,বাঁয়ে থেকে যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেনো দর্শকের দৃষ্টিতে ক্লান্তি আসে না,আরও দেখার পিপাসা জাগে। আমি রাজ্জাক সাহেবকে মনে মনে তাজমহলের সঙ্গেই তুলনা করতে থাকলাম। ‘ একজন ব্যক্তির তেমন কোন বই প্রকাশিত না হয়েও কীভাবে সমকালীন কিংবদন্তি হয়ে উঠতে পারেন তা বিস্ময়ের ব্যপার। আশ্চর্য হলেও সত্য যে প্রফেসর রাজ্জাক সাহেবের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা একটি! আসলে সারাদিন-রাত শুধু পড়ে গেছেন মানুষটি। কিছু লিখলেও প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না।
১৯২৭ সালে নজরুলের গানের মজলিসে স্ব শরীরে যিনি উপস্থিত ছিলেন,জসিমউদদীন যার বন্ধু ছিলেন,মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে অসংখ্য সময় কাটানো যিনি,হেনরি কিসিঞ্জার যার ক্লাস মেট ছিলো, যিনি হ্যারল্ড লাস্কের সরাসরি ছাত্র ছিলেন, এভাবে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে নিজেকে হীরকখণ্ডে রুপান্তরিত করা মানুষটি প্রফেসর রাজ্জাক। কমলা রঙের মলাটের এ বইটিতে সেসব ফিরিস্তি উঠে এসেছে। আহমদ ছফার জবানিতে উঠে এসেছে রাজ্জাক সাহেবের প্রাচ্য ইতিহাস,রাজনীতি, ভূগোল, দর্শন, সাহিত্য সমালোচনাসহ নানান বিষয়ের জ্ঞান। প্রফেসর রাজ্জাক সাহেবকে জীবন্ত বিশ্বকোষ বললে ভুল হবে না। আলোচিত ১১০ পাতার এ বইটিতে উঠে এসেছে বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সূদুর প্রসারী মন্তব্য। তাদের মধ্যে আছেন সাহিত্য অঙ্গনের নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদার, জসিম উদ্দিন, শেক্সপিয়ার, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন, রামমোহন রায়,অ্যাডাম স্মিথ,শরৎ চন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, সালমান রুশদী, আহমদ শরীফ,বঙ্কিমচন্দ্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। উঠে এসেছে রাজনীতির মাঠের শেরে বাংলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কমরেড আবদুল হক,মাওলানা ভাসানী, জওহরলাল নেহেরু, বঙ্গবন্ধু, মাওঃ আবুল কালাম আজাদ,জিন্নাহ,। বাদ পড়েনি শিল্পাচার্য জয়নুল,কামরুল হাসান,সুলতান আহমেদের কথা। মোট কথা ত্রিশেরও অধিক বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে বইটিতে। উদারমনা প্রফেসর রাজ্জাক স্নেহের স্বরে ছফা কে ডাকতেন ‘মৌলবি আহমদ ছফা ‘ বলে। অর্থাভাবে প্রায়ই নাশতা না করা ছফাকে নিজ বাড়ীতে একসঙ্গে নাশতা করাতেন। কৃতজ্ঞতার সুরে সে কথা উল্লেখ করেছে আহমদ ছফা। বইটিকে এখন দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। ক) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার বেহাল দশা। খ) বাস্তব উক্তি
১৯২১ সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও আইসিএস পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি! যেটি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ঘটেনি। অন্যদিকে গবেষণার নামে ঢাবি শিক্ষকরা যতটুকুই করেছেন সেটাও চাকুরির প্রমোশনের জন্য। বাস্তব এ সত্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অকপটে বলে গেছেন। সে সাথেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ টি অবদানের কথা স্বীকার করেছেনঃ ১। পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত তৈরি। ২। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দান। ৩। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,সংকল্প ও কর্মপন্থার দিকনির্দেশনা। তরুণ প্রজন্মের চাহিদা পূরণে অক্ষম হওয়া শিক্ষক সম্প্রদায় সম্পর্কে রাজ্জাক সাহেব বলেনঃ”আমরা শিক্ষকেরা প্রতি বছরই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন বছরের ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুণদের চাহিদা-চাওয়া পাওয়ার খবর আমাদের মতো লোলচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়। এটাই হলো শিক্ষক জীবনের সবচাইতে বড় ট্রাজেডি। ” খ) পুরান ঢাকার অধিবাসী রাজ্জাক সাহেব ঢাকাইয়া ভাষায় প্রাঞ্জল গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা আহমদ ছফার জবানিতে প্রতীয়মান। ১। ” প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন কাউকে সালাম দিলে, সালামটা তার প্রাপ্য বলে ধরে নেন এবং যিনি সালাম দেন তাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিতান্তই ছোটলোক বলে ধরে নেয়া হয়।”– আহমদ ছফা ২। “যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন,দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন।ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর কী লেখাপড়া করে।” ৩।”উপন্যাস অইলো গিয়া আধুনিক সোশিয়াল ডিসকোর্স।” ৪। “বাংলা ভাষাটি ত রবীন্দ্রনাথের হাতেই পুষ্ট অইছে।”
মুহাম্মদ রিয়াদুল ইসলাম