ঢাবি প্রতিবেদকঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপমানের অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী এহসান উল্লাহ ধ্রুব। তবে অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অভিযুক্ত ওই শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান।
পরে দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরপাড়ে এহসানের খোঁজ মেলে। তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। তিনি একসঙ্গে অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন বলে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের ভাষ্য। এহসানের ফেসবুক পোস্টে একই ইঙ্গিত রয়েছে। পরে তাকে গুরুতর অবস্থায় হলের পুকুর পাড় থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আজ শুক্রবার সকাল ৮টায় তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেয়া হয়েছে। তার অবস্থা এখন ভালো বলে কর্তব্যরত নার্স ও পরিবার জানিয়েছে। এহসান উল্লাহ ধ্রুব বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এবং শাখা ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপ-সম্পাদক।
ছাত্রলীগের বিক্ষোভ
এহসান উল্লাহ ধ্রুব’র খোঁজ না পেয়ে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে একটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় বিভিন্ন হল থেকে নেতাকর্মীদের ঘুম ভাঙিয়ে সেখানে জড়ো করে ছাত্রলীগ। এসময় তারা ‘শিক্ষকদের নগ্ন কাজ, রুখে দাঁড়াও ছাত্রসমাজ’, ‘শিক্ষার্থীর ওপর নির্যাতন কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘শিক্ষকদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘আমার ভাই নিখোঁজ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ জাতীয় স্লোগান দেন।
ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করা শিক্ষার্থী ধ্রুব বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক উপ-সম্পাদক।
একদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ধ্রুবের এক বন্ধু-জানান, ধ্রুব খুব ভালো ছেলে। সুন্দর ছবি তোলার সুবাদে তার অনেক রাজনৈতিক মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। সে হল ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে উপ-প্রশিক্ষণ সম্পাদক পদ পেয়েছিলো। কয়েকদিন আগে বিভাগের একটি ট্যুরে সুন্দরবন গিয়েছিল তার সহপাঠীরা। সেখানে এক মেয়ে বন্ধুর কিছু কার্যক্রম নিয়ে ‘কুৎসা’ রটানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। অথচ ধ্রুব ট্যুরেই যায়নি। কিন্তু বৃহস্পতিবার শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাকে সন্দেহ করেন অধ্যাপক তানজিমউদ্দিন খান। সন্দেহ করে তাকে খারাপ, বখাটে ছেলে বলে আখ্যা দেন। পরে ধ্রুব ক্লাসে কান্না করলেও অধ্যাপক তাকে ছাড় দেননি। পরে রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিখোঁজ হন তিনি।
সহপাঠীর বক্তব্য
এদিকে বিষয়টি খোলসা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস ও দিয়েছেন ধ্রুবের সহপাঠী মাহবুবুর রহমান।
ওই স্ট্যাটাসে মাহবুবুর লিখেছেন, …গতকাল বৃহস্পতিবার সে (ধ্রুব) ক্লাসে আসার আগেই স্যার আমাদের ক্লাস শুরু করেন এবং ইতোমধ্যে আমাদের একবার বকা দেন যে ক্লাসমেটদের নিয়ে মিথ্যা গুজব ছড়ানো আমাদের ‘র্যাশনাল’ বিহাভিয়র না। এরপর স্যার একেবারে পূর্বের মতোই বলেন- ইচ্ছা করে তোমাদের ছয়তলার ছাদ থেকে ফেলে দেই অথবা তোমাদের সাথে লাফ দেই। এরপর যথারীতি পড়ানো শুরু করেন। ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে ধ্রুব ক্লাসে আসে, স্যার পড়াতে থাকেন। শেষের দিকে স্যার ধ্রুবকে দাঁড়াতে বলেন এবং বলেন এই যে ক্লাসমেটদের সম্পর্কে এত বাজে গুজব তৈরি করলে, তোমাকে এসব কে বলেছে? স্যার কথাটা ধমকের স্বরেই বলেছেন। এরপর ধ্রুব বলেন, স্যার অনেকেই বলেছে। স্যার বলেন, নাম বলো। ধ্রুব বলেন, I can show you screenshots sir, but I can not tell my friends name. স্যার বলেন, না না, তোমার নাম বলতে হবে। এরপর স্যার ওকে কয়েকটা ধমক দেন এবং বলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একজন শিক্ষার্থীর এটা বোঝা উচিত তার নিজের ক্লাসমেটদের সম্পর্কে কি বলা যায়, কী বলা যায় না। তুমি ভুলে গেছো আমি তোমার শিক্ষক? একজন শিক্ষকের সামনে তুমি এসব কথা কিভাবে বলো! ধ্রুব বলতে চেষ্টা করে, I want to say something sir. স্যার ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন যে, তুমি একজনকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে, সেখান থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে তুমি তোমার ক্লাসমেটের সম্পর্কে এভাবে কুৎসা রটনা করতে পারো না। এরপর স্যার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যান। যতদূর শুনেছি এরপর ধ্রুব স্যারের কাছে সরি বলতে যায় এবং স্যার আবার ওর সাথে নীচে নামেন এবং ফুচকাও খাওয়ান। এ ঘটনায় আমার ক্লাসমেট ধ্রুবের পোস্ট এবং সুইসাইড এটেম্পট দুঃখজনক। যেহেতু ওকে পাওয়া গেছে, আমরা ওর দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। কিন্তু এই ঘটনার মধ্যে রাজনীতি কোথা থেকে এসেছে সেটা আমরা ক্লাসে উপস্থিত ৫০ এর বেশি শিক্ষার্থী কেউই বুঝতে পারছি না। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতে গোণা কয়েকজন শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকের মধ্যে উনাকে পেয়েছি।
পরে রাত ২টা ১৫ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছান। এর কিছুক্ষণ পরেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমী আসেন। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললে রাত ৩টার দিকে হলে ফিরে যান তারা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ধ্রুব’র মার সাথে আমার আজ সকালেও কথা হয়েছে ও আগে থেকেই হতাশাই ভুগছে। এ দিকে এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, একজন শিক্ষকের কখনো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে সবার সামনে অপমান করার অধিকার নেই। যে ছাত্র কি-না ট্যুরে যায়নি, সে কীভাবে ট্যুরের বিষয়ে বন্ধুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবে? তিনি অভিভাবকসুলভ আচরণ থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ ছেলেদের মাঝে ছড়ানোর চেষ্টা করতেন।