ঢাবি প্রতিবেদকঃ
‘আমাকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হয় যে তুই কই আছিস বল। তখন আমি বললাম জিয়া হলের দিকে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জন ছেলেপেলে এসে আমাকে বেদম প্রহার করতে থাকে। উপর্যপুরি কিল ঘুষি এবং ইট দিয়ে আঘাত করে। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী। ফিল্মি কায়দায় পেটানো হয় আমাকে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে শুয়ে এভাবে মারধরের বর্ণনা দিচ্ছিলেন মারধরের শিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী যোবায়ের ইবনে হুমায়ূন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী।
কারা এরা ? খোঁজ নিয়ে কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে এল সাপ। এ এক ভয়ংকর গ্যাং। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের গণ্ডিই পার করতে পারে নি কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রন করে ক্যাম্পাসের পানির ব্যবসা।
আর এ গ্যাংয়ের নাম হচ্ছে ‘প্রলয়’। যারা ক্যাম্পাসে মারামারি, ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত তাদের নিয়েই এই প্রলয় গ্যাং। ডা. শহীদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের তৃতীয় তলায় তাঁরা গ্যাংয়ের কার্যালয় বানিয়েছেন। ক্যাম্পাসে নানা অপকর্মে তারা জড়িত। নিয়মিত নেশার আসর বসায় তারা যেখানে থাকে মেয়েদের আনাগোনাও। কিছু মেয়েদের নাম প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরের পাশে তাঁদের নেশার স্থান। ওই জায়গার নাম দিয়েছেন ‘নিকুম্ভিলা’।রুটিনমাফিক সেখানে জড়ো হন সদস্যরা, ক্যাম্পাসে দেন বাইকের মহড়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবাই সংঘবদ্ধ ছবি দেন নিয়মিত। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল শিক্ষার্থী। সবাই ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
গ্যাংয়ের নেতৃত্বে আছেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল এবং শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের তবারক, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র মাহিন মুনাওয়ার, , ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের সিফরাত সাহিল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও দর্শন বিভাগের অর্ণব খান, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাদমান তাওহিদ বর্ষণ, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের হেদায়েতুন নুর, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সৈয়দ নাসিফ ইমতিয়াজ, ইতিহাস বিভাগের বদরুজ্জামান সজীব, মার্কেটিং বিভাগের বিপ্লব হাসান জয় ও মোহাম্মদ শোভন, প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগের শাহ আলম, মাস্টারদা সূর্য সেন হলের তৌসিফ তাহমিদ অর্পণ ও নাজমুল হোসাইন, কবি জসীম উদ্দীন হল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদ, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তাহমিদ ইকবাল মিরাজ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবু রায়হান ও জগন্নাথ হলের প্রত্যয় সাহা।
এর মধ্যে নাজমুল হোসাইন ও তৌসিফ তাহমিদ অর্পণ মাস্টারদা সূর্য সেন হল ছাত্রলীগের সহসম্পাদক, মাহিন মুনাওয়ার শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সহসম্পাদক।
জানা যায়, প্রতিটি হল থেকে প্রথম বর্ষ পড়েন– এমন মারদাঙ্গা এবং নেশাগ্রস্ত ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদের বাছাই করে তারা এই গ্যাংয়ে জড়ো করেছেন। ক্যাম্পাসে এবং উদ্যানে নিজেদের আড্ডা, মাদক, ছিনতাইয়ের জগৎ গড়ে তোলেন। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে মারধর এবং অন্যান্য অপরাধে কয়েকজনকে বিভিন্ন মেয়াদে হল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করেন। ঢাবি মেডিকেলের তৃতীয় তলায় নিজেদের কার্যালয় গড়ে তুলেছেন।সেখানে কোন রোগী থাকলে তাদের যন্ত্রণায় বের হয়ে যেতে হয়।
গতরাতে তাঁদের মারধরে আহত জুবায়ের জানান, কার্জন হলের সামনে অভিযুক্তরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাইক চালাচ্ছিলেন। সেটা দেখে তিনি তাঁদের বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এ সময় তাঁদের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয়। এর পর তিনি হলপাড়ায় আসেন। কিছুক্ষণ পর অপরিচিত নাম্বার থেকে (সাহিলের নাম্বার) ফোন করে তবারক তাঁর লোকেশন জিজ্ঞেস করেন এবং দেখা করতে চান। তিনি দেখা করতে এলেই দলের সব সদস্য মিলে তাঁকে মারধর করে রক্তাক্ত করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা বলেন, হঠাৎ করে একদল শিক্ষার্থী এসে ছেলেটিকে মারতে শুরু করেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, বিজয় একাত্তর হল এবং জসীম উদ্দীন হল থেকে ওই ছেলের বন্ধুবান্ধব দৌড়ে আসেন। এ সময় তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয় সেখানে। তবে এর মধ্যে তাকে মেরে তাঁরা পালিয়ে যান। পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী যোবায়েরকে রিকশায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।
কি করে না তারা?
প্রলয় গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয় শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের তবারক । তবারককে প্রথম বর্ষে হল থেকে বের করে দেওয়া হয় তার কর্মকাণ্ডের কারণে। তারপর সে ও তার বন্ধুরা শেখ রাসেল আবাসিক ভবনে একটি রুম নিয়ে থাকত, সে তখন শহীদ মিনার ও উদ্যান এরিয়াতে ছিনতাই চাঁদাবাজি, মেয়েদের যৌন হয়রানি করা শুরু করে। সে হয়ে যায় এক মূর্তিমান আতঙ্ক। সে ছিনতাইয়ের টাকা দিয়ে পূরণ করত তার সকল বিলাসিতা। সে তারপর তার ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করে পানির ব্যবসা। একটি অখ্যাত পানির কোম্পানির পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশে পাশের দোকানে সাপ্লাই দেওয়ার জন্য দোকানিদের হুমকি দেওয়া শুরু করে ,কথা না শুনলে দেওয়া হয় প্রাণনাশের হুমকি।
এই কুখ্যাত প্রলয় গাংয়ের দুই সদস্য গতবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সিনিয়র শিক্ষার্থীকে মেরে বহিষ্কার হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, একটি গ্রুপকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শনিবারের ঘটনাটি তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। হলের প্রাধ্যক্ষকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এ বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলে তিনি জানাতে বলেন।
ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই। আমরাও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে চায় ছাত্রলীগ। এখানে কোনো গ্যাং কালচারের অপকর্ম সহ্য করা হবে না।