নাজিম উর রহমান
গত ৩০ মার্চ ৪০ তম বিসিএসের ফল প্রকাশিত হয় ।৪০তম বিসিএসে ১ হাজার ৯৬৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে পিএসসি।যারা ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিভিন্ন বিভাগের ক্যাডার হয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে তা নিয়ে একটি সিরিজ প্রতিবেদন তৈরি করছে মর্নিং ট্রিবিউন । আজ হচ্ছে তার ১৩তম পর্ব।
আজকে আমাদের সাথে আছেন , মুকুন্দ কুমার পাল যিনি ৪০তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে(রসায়ন) সুপারিশপ্রাপ্ত। এই প্রতিনিধির সাথে যখন অনলাইনে কথা হয়েছিল তখন নিজের অতীত কর্মজীবন আর অধ্যবসায়ের গল্প তারপর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার যে জার্নি আর তার আগামীর কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে বলছিলেন যশোর সরকারি এম এম কলেজের রসায়ন বিভাগের সাবেক ছাত্র মুকুন্দ কুমার পাল।
মুকুন্দ কুমার পাল বলছিলেন, তার জীবনের মূলমন্ত্রের কথা তখন তিনি বলেন প্রত্যেক মানুষের সফলতার পিছনে থাকে দীর্ঘ সংগ্রাম অনেক ত্যাগ আজ এই ছেলেটি সে যে এতদূর আসতে পেরেছে বা আজ যতটুকু সফলতা অর্জন করেছে তার পিছনে আছে একটা দীর্ঘ সংগ্রাম অনেক ত্যাগ এবং পদে পদে না পাওয়ার হাহাকার।
নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন,কষ্ট বুকে চেপে রেখে বাবাকে সুস্থ করে তোলা, ভাইকে লেখাপড়া করানো,মায়ের মুখে হাসি ফুটানো তথা পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে পরিবারকে আগলে রাখার নিরন্তর চেষ্টা। আমি যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলার গ্রামের স্কুলে দশম শ্রেণিতে ফার্স্ট বয় ছিলাম। এস এস সি ফলাফল প্রকাশের দিনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি এক বিষয়ে (রসায়ন) ফেল করে। ঠিক ঐ দিন আমাদের বাড়িতে অত্র গ্রামের লোকজনের লাইন লেগে যায় কোন সুখের সংবাদ শুনে নয়,আমাকে এবং আমার পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য । সময়টা ছিল তখন ২০০৬ সাল।
সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ঠিক ১৬ বছর পরে বর্তমানে ২০২২ সালে ঐ একই ঘটনা ঘটে আমাদের বাড়িতে এবার গ্রামের মানুষ আমাদের বাড়িতে আসে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে,এটা কিভাবে সম্ভব হলো যে ছেলেটি এসএসসিতে ফেল করেছিল সে কিনা আজ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার। এবার সবারই আমার বাবা মা কে অভিনন্দন জানতে আসে । বাবা মার বুকটা গর্বে বুকটা ভরে ওঠে।
আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না আর তাছাড়া বাবার শ্বাস কষ্ট জনিত সমস্যা থাকায় আমার মাকে শক্ত ভাবে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। মা আমার কাছে সুপার হিরো। আর আমি মায়ের সংগ্রামের সারথী হয়েছি। সবসময় পেয়েছি আমার ছোট ভাইয়ের সহযোগিতা এবং সহধর্মিনীর সমর্থন।পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য আমকে ক্লাস টেন থেকে টিউশন করাতে হয়েছে কখনও বাজারে পেয়ারা বিক্রি করা কখনও বা ভুট্টা বিক্রি কখনও বা পরের জমিতে কামলা খেটে উপার্জন করেছি।
২০০৬ সালে আমার এস এস সি তে ফেল ফেল করার পর মুকুন্দ কুমারের সংগ্রামটা আরো কঠিন হয়ে যায়। বাবা মা ভেঙে পড়েন ঠিক তখনই তিনি সংকল্প করেছিলেন জীবনে সফল হবেন আর বাবা মার মুখে হাসি ফুটাবেন ২০০৭ সালে যখন তার বাবার হার্টের অসুখ ধরা পড়ে তখন তার বাবা আর কাজ করার অবস্থায় ছিলেন না ঐ সময় পরিবারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। ঐ সময় তাদের উপার্জনের একমাত্র উৎস ছিল ২টি গরু মাত্র । ২০০৭ সালে তিনি কলেজে ভর্তি হন। ঐ সময় তার বাবার হার্টে একটা সার্জারি করানো হয়। তার বাবার চিকিৎসা নিজের পড়ালেখা পরিবারের খেয়াল রাখতে কখনও গরু দিয়ে জমি চাষ পরের জমিতে ধান কাটা কখনও বা পাট কেটে অথবা টিউশন করিয়ে আয় করতে হয়েছে। এভাবেই চলেছে তার উচ্চ মাধ্যমিক এর পড়ালেখা।
তিনি ২০০৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন । এইচ এস সি পাশের পর ভর্তি কোচিং করার সুযোগ হয়নি আর তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়নি। অবশেষে যশোর সরকারি এম এম কলেজে ভর্তি হন রসায়ন বিভাগে। শুরুতে এক বছর বাড়ি থেকে ৫০কি.মি সাইকেল চালিয়ে যাওয়া আসা করতেন। অনার্সে পড়ার সময় টিউশন করিয়ে আবার ছুটিতে বাড়ি এসে পরের জমিতে কাজ করে পড়ালেখার খরচ চালাতেন ।এভাবে শেষ হয় অনার্স আর সিজিপিএ ৩.৪৩ পেয়ে তার বিভাগে তিনি প্রথম হন।
তিনি আরও বলেন,শত প্রতিকূলতার মাঝেও স্বপ্ন দেখেছিলাম আইএলটিএস শেষ করে বিদেশে মাস্টার্স করব। ২০১৫ সালে ঢাকা আসি তারপর পরীক্ষা দিয়ে ব্যান্ড স্কোর ৬.০০ পাই। ২০১৬ সালে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পাই। যখন বাবা মা কে জানাই যে প্রায় দশ লক্ষ টাকার মত খরচ হবে যেতে। তখন বাবা বলেন বিদেশে না যেয়ে দেশে থেকে দেশের জন্য কিছু করা যায় কি না দেখো। বাবার এই কথাটি আমাকে খুব আন্দোলিত করে তুলে। মূলত এর পর থেকে বিসিএস এর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। তাই বিদেশে যাওয়া বাদ দিয়ে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই মাস্টার্সে। পাশাপাশি নীলক্ষেতে একটি বিসিএস কোচিং এ ভর্তি হই। ঢাকায় থাকাকালীন টিউশন করানো, কখনও কবির পাবলিকেশনে লেখালেখি করিয়ে মাস্টার্সের খরচ,ঢাকায় থাকা ও বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। এরমধ্যে ২০১৯ সালে ঢাকা মেট্রো রেলে চাকরি পাই এবং বতর্মানে এখানে কর্মরত আছি। চাকরির পাশাপাশি বিসিএস এর পড়ালেখা করতে হয়েছে। অবশেষে ২০২২ সালে ৪০তম বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফলে আমি সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার (রসায়ন)সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি।
বিসিএস প্রস্তুতি নিয়ে তিনি বলেন, আমি মনে করি বিসিএসে সফল হওয়ার জন্য সিলেবাসটা ভালো করে জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজের উপর বিশ্বাস রাখা,ধৈর্যশীল হওয়া।আর লেগে থাকার মানসিকতা থাকা একান্ত প্রয়োজন। বাবা জানত না বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য কি কি করতে হয় কিভাবে পড়তে হয় কিন্তু তিনি এটা জানতেন বিসিএস ক্যাডার হওয়া বড় সম্মানের ব্যাপার। তাই আমার ফলাফল শোনার পর বাবা মা কে যতটা খুশি দেখেছি আমার ৩০ বছরের জীবনে এমন কখনও দেখিনি। বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি এর চেয়ে বড় পাওয়া একজন সন্তানের জীবনে আর কি হতে পারে!
আমার বাকি জীবন টা দেশের জন্য কাজ করতে চায়। তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমার ফেসবুক পেজ (Mukunda Tutorial )থেকে সরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্য সম্পূর্ণ বিনামুল্যে পরীক্ষা ও ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আমার এই পথচলা দেশবাসীকে জানাতে চাই এই জন্যে যে মানুষের মনবল যদি দৃঢ় হয় সংকল্প যদি অটুট থাকে আর কঠোর পরিশ্রম করার ইচ্ছা।
সম্পাদক: ড. রহমান মাসুক অফিস: ১২৯,এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা-১২০৫। ফোন ও ইমেইল (নিউজরুম): ০১৫৫৮১০৪১৬১; morningtribune@yahoo.com
Copyright © 2024 Morning Tribune. All rights reserved.